ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশালঃ ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বরিশাল


কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত ধান-নদী খালের অপূর্ব সমাহার বরিশাল। বরিশাল দক্ষিণ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং বরিশাল বিভাগের সদর দপ্তর। দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র পলি জমে সৃষ্ট কয়েকটি দ্বীপ বরিশাল। এ অঞ্চল বা এর অংশ বিশেষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে পরিচিত ছিল।
প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। পাঙ্গালা, সাগরদ্বীপ, চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গাল প্রভৃতি ছত্রিশটি নামার পরিচয় পাওয়া যায়। চন্দ্রদ্বীপ কখনো পরগণা, কখনো বা রাজ্য হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তারকালে দনুজমর্দন কর্তৃক চন্দ্রদ্বীপ নামে এ স্বাধীন রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই নদী ভাঙ্গন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা এ অঞ্চলের মানুষের পেশা কৃষি ও মৎস্য শিকার। গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত চন্দ্রদ্বীপে লোকবসতি কবে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাচীন পুঁথি থেকে ধারণা পাওয়া যায় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের জন্ম ৪ হাজার বছর পূর্বে। প্রাচীনকালে এই দ্বীপে ছিল অসংখ্য নদী-নালা। এ রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চল বাকলা নামে পরিচিত ছিলো। নবাব আলীবর্দী খানের সময় আগা বাকের খান চন্দ্রদ্বীপের একাংশের জমিদারী লাভ করে বাকেরগঞ্জ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৭ সালে ঢাকা জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ সালে জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশাল (গিরদে বন্দর; গ্রেট বন্দর) স্থানান্তরিত করা হয়। কালক্রমে জেলার মূল নাম বাকেরগঞ্জের পরিবর্তেস বরিশাল নামটিই পরিচিতি লাভ করে। দেশের খাদ্যশস্য ও মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম মূল উৎস বরিশাল। একে বাংলার ভেনিস বলা হয়। বরিশাল নামকরণ সম্পর্কেও অনেক মতভেদ রয়েছে। বড় বড় শালগাছের কারণে, (বড়+শাল)> বরিশাল, বড় বড় ঘর (শাল) থাকার কারেণে বড়ি (বড়) + শাল (ঘর) বরিশাল; পর্তুগীজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনীর জন্য বরিশাল; বড় বড় লবনের বরিশাল ইত্যাদি। গিরদে বন্দরে ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের গোলা ও চৌকি ছিলো। ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা বড় বড় লবণ চৌকিকে 'বরিসল্ট' বলতো। পরবর্তীতে শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে 'বরিশাল' হয়েছে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ও ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিল খুলনা বিভাগের অন্তর্গত। নদীর অববাহিকার এ জেলার বয়স দু’শ’ বছর পেরিয়ে গেছে। বরিশাল দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। এককালের বরিশাল জেলা শহর বর্তমানে রূপ নিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় শহরে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরিশালের রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে নাম দিয়েছিলেন প্রাচ্যের ভেনিস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এ শহরের আত্মীয়তা ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এখানে জন্ম নিয়েছেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, বাংলার বাঘ বলে খ্যাত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কবি সুফিয়া কামাল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, নলিনী দাস, মনোরমা মাসিমা অমৃত লাল দে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল, কৃষক কুলের নয়নমণি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেক ক্ষণজন্মা নারী-পুরুষ। একুশে ফেব্রুয়ারি ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে বরিশালের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের রচয়িতা ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী এবং গানটির সুরকার ও শিল্পী আলতাফ মাহমুদ জন্ম নিয়েছেন এ জেলায়। আলতাফ মাহমুদের নামে নগরীতে রয়েছে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। এছাড়াও স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, বীরোত্তম আব্দুস সত্তার ও মেজর জলিলকে নিয়ে এখানকার মানুষ এখনও গর্ববোধ করেন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বরিশাল শহরে। একইভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অপর নেতা চারণ কবি মুকুন্দ দাসের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই শহরে। এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ায় নদী ও খালের সঙ্গে যুক্ত করেই প্রবাদ রচিত হয় ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’। বালাম চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এ জেলা। (দূর্গা সাগর দীঘি) ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ পরগনার তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সঙ্কট নিরসনে মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করেছিলেন। তার মা দুর্গা দেবীর নামে দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিবর্তে দুর্গাসাগর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জেলা প্রশাসন। দুর্গাসাগরের তিনদিকে তিনটি ঘাটলা ও দীঘির ঠিক মাঝখানে ৬০ শতক ভূমির ওপর টিলা রয়েছে। দুর্গাসাগরের অদূরেই রয়েছে অত্যাধুনিক বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক জাদুঘর। এ জাদুঘরটি বানারীপাড়ার চাখারে শেরেবাংলার জন্ম ভিটায় অবস্থিত। লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি প্রায় তিন’শ’ বছরের পুরনো। খাল-বিলে ভরা এ জেলার মানুষের এক সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল একমাত্র নৌকা। গয়নার নৌকা থেকে শুরু করে এখন যাত্রীসেবায় যুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল দোতলা-তিনতলা লঞ্চ। যোগাযোগের মাধ্যম নৌপথের পাশাপাশি আজ সড়ক ও আকাশ পথের উন্নতি হয়েছে। জীবনান্দদের স্মৃতিবিজড়িত রূপসী বাংলার রূপের মাধুর্য ছড়িয়ে ছিটেয়ে আছে এখানের প্রতিটি পথে প্রান্তরে । ঘর হতে শুধু দু'পা ফেলিয়া সময় করে আসুননা প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালে।