দূরের সংবাদপত্রে বাংলাদেশ ১৯৭১
জয়েন্ট কমাণ্ডের প্রধানের নিকট জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদ-মাধ্যমে এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন রিপোর্ট বা সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এগুলো পরে ভারতের ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্ট’ এবং বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’-এ একত্রে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এরকম কিছু রিপোর্ট ও সম্পাদকীয়-এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হলো। আন্দালিব রাশদী ভারতের ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্ট’ এবং বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ থেকে এগুলো নির্বাচন ও অনুবাদ করেছেন।
এএফপি’র একটি প্রতিবেদন যা প্রচারিত হয়নি
পিকিং, নভেম্বর ১৫,১৯৭১ (এএফপি)
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, চীন স্পষ্টভাবে এবং উপর্যুপরি পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিযেছে যে, ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ বেঁধে যাক—এটা চীন চায় না।
উৎস জানাচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ঝুঁকির বিষয়টি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দূত জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সেনাবাহিনীর তিন প্রধানকে এক সপ্তাহ আগের একটি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং অন্যান্য চীনা নেতারা অবহিত করেছেন।
বিশেষ করে তিন জন পাকিস্তানী কমান্ডারের সঙ্গে আলোচনার সময় চীনারা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য জোর দিয়েছে। এই পাকিস্তানীদের তিন দিনের পিকিং সফরের সময় ভারপ্রাপ্ত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘ভারতের অমার্জনীয় হস্তক্ষেপ’-এর নিন্দা করেছেন এবং জোর দিয়ে বলেছেন যে, দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা উচিত, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে চীনাদের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে বলা হয়, ভুট্টোর সফরের ফলশ্রুতিতে কোন যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়নি, এর বিপরীতে ভারতের প্রতি সোভিয়েত প্রতিশ্রুতি ব্যাপক প্রচারণা পায়।
চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া গত সপ্তাহে ভারত সম্পর্কে মন্তব্য করে আগের সাত মাসে পূর্ব ভারতের সম্প্রসারণবাদ নীতিকে নিন্দা করা হয়েছিল।
ভারত-পাকিস্তান সমস্যায় চীনের কৌশলগত অবস্থানের পেছনে কুটনৈতিক সূত্র মতে চারটি কারণ রয়েছে:
১. চীন দেখাতে চায় যে জাতিসংঘে দেশটির অন্তর্ভূক্তির ফলে এই বিশ্ব সংস্থাটি আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে।
২. চৌ এন লাই-এর কুটনৈতিক পরিকল্পনা হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে (দক্ষিণ এশিয়াও) দুটি পরাশক্তির দ্বন্দ্ব বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত থেকে রক্ষা করা।
৩. ভারতের সঙ্গে আঁতাত সৃষ্টির সুযোগ নষ্ট হয়—এমন পদক্ষেপ নেয়ার প্রশ্নে পিকিং অনাগ্রহী থাকবে। জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভূক্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী চৌ এবং ইন্দিরা টেলিগ্রাম বিনিময় করেছেন। মিসেস গান্ধী বলেছেন, বিশ্ব সংস্থায় তিনি চীনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন এবং চৌ এন লাই বলেছেন চীন ও ভারতের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি পিকিং-এ অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে চীন ভারতীয় দলকে স্বাগত জানিয়েছে এবং গত ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম দুজন ভারতীয় সাংবাদিককে চীন আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
৪. স্বাধীন বাংলাদেশ না চীনের স্বার্থ, না চীনের আদর্শ—কোনটাই রক্ষা করবে না।
চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের মৈত্রীর সম্পর্ক এতে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ভারসাম্য ওলটপালট হয়ে যাবে।
ভুট্টোর সফরের সময় চি পেং ফি তাঁর ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গালমন্দ করেন এবং বলেন, কেবলমাত্র পাকিস্তানী জনগণই যুক্তিযুক্ত পথে পুর্ব পাকিস্তান সমস্যার নিষ্পত্তি করবে।
এই ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধানে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানানো হয়নি।
মুজিবের রাষ্ট্রদ্রোহের প্রকৃতি
দ্য সানডে টাইমস, জাম্বিয়া ২২ আগস্ট ১৯৭১
১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। পাকিস্তানের শুরু থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহের ধরণ ও ইতিহাস বোঝা প্রয়োজন।
…১৯৬৬ সালে যখন মুজিবুর স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা ঘোষণা করলেন—যার ওপর ভিত্তি করে গত নির্বাচনে তার নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটল—তখনই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হল। সরকারের সমর্থনপুষ্ট সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করলে তাদের উদ্ভাবিত অভিযোগ এক সময় ঝেড়ে ফেলতে হয়।
স্বায়ত্তশাসনে দাবি জানানো নতুন কিছু নয়। এমনকি পাকিস্তানের ভিত্তি হিসেবে খ্যাত লাহোর প্রস্তাব, যার খসড়া জিন্নাহ নিজেই প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে বলা হয়েছে, ভারতকে এমনভাবে ভাগ করতে হবে—পূর্বে ও উত্তর-পশ্চিমে মুসলিম সংখ্যাগিরষ্ঠ অংশে একের অধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে যার ইউনিট গুলো হবে স্ব-শাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় ইউনিট রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্য বিস্তার করে শাসন করে গেছে।
কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ১৯৭০ সালে মুজিব ও তার দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগিরষ্ঠতায় বিজয়ী করে নিয়ে আসে।
তারপর গণহত্যা শুরু হয়, মুজিব আবার বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে—লাহোর প্রস্তাবে যে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে, মুজিবের ছয় দফায় তাও চাওয়া হয়নি। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।…
২৬ মার্চ ১৯৭১
সানডে পোস্ট, নাইরোবি
ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশ পরিস্থিতি
শরণার্থী সামাল দেয়া এবং শরণার্থীর কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক যে হুমকি তা মোকাবেলা করতে যতটুকু প্রয়োজন পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ওইটুকুই। যেসব প্রচারণা শুরু হয়েছে তা যদি বিশ্বাস করতে হয়, মনে হবে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের ভারতের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের খাঁচায় পুরে রাখা হয়েছে এবং বলপূর্বক তাদের দেশে ফিরে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে।
এই শরণার্থী শিবিরগুলো উন্মুক্ত ও স্বাধীন। কেউ যদি শিবির ছেড়ে চলে যেতে চায়, চলে যাবে। কোন বাধা বা নিষেধ নেই।
যে কুটচালের বাহুল্যে এসব কথা বলা হচ্ছে তাতে শরণার্থীর সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কথা নয়। একটি পরিসংখ্যানের সূত্র মতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিশ থেকে পঁচিশ লক্ষ লোক চলে গেছে।ইয়াহিয়া খান একজন সাংবাদিকের কাছে স্বীকার করেছেন শরণার্থীর সংখ্যা ত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ হতে পারে, আশি বা নব্বই লক্ষ—অসম্ভব। বিবিসির একটি অনুসন্ধানী ধারাভাষ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ফিরে আসছে তাদের তিন থেকে চার বার পরীক্ষা করা হচ্ছে যেন প্রকৃত বাস্তুচ্যুতই কেবল ঢুকতে পারে, কোন প্রতারক নয়।
ধারাভাষ্যে আরও বলা হয়, সব শরণার্থীর অবস্থান শিবিরে নয়; শিবিরে আছে কেবল যারা দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে অসহায়। পূর্ব পাকিস্তানের অনেকেই আশ্রয় পেয়েছে কলকাতাও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।
তাদের প্রকৃত সংখ্যা কখনোই রেকর্ড করা হয়নি। সবাই ফিরে যেতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর সামনে যে বিশাল ট্র্যাজেডি তা হচ্ছে কেউ কেউ মনে করছেন নব্বই লক্ষ মানুষ কোন বোঝাই নয়—যে দেশে নিজেদের জনসংখ্যা বাড়ে বছরে এক কোটি বিশ লক্ষ। এই নব্বই লক্ষ্যের দায় রাষ্ট্রের। আর এ সময় যেসব সন্তান জন্ম গ্রহণ করছে তার দায় সন্তানের পিতা-মাতার।
(২২ নভেম্বর ১৯৭১ প্রকাশিত)
মাইনিচি ডেইলি নিউজ, টোকিও
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাস্তিানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত শরণার্থী সমস্যা সমাধানের কোন সুযোগ নেই। যুদ্ধের বিপজ্জনক আশঙ্কার কথাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। ইয়াহিয়া খান সরকার বেসামরিক সরকার পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েই গেছে। খাদ্যের ঘাটতি রয়ে গেছে। জাপানসহ অন্যান্য দাতাদেশ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আনা পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া স্থগিত রেখেছে। আশা করা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করে যত শীঘ্র সম্ভব সাহায্য প্রবাহ পুনরায় চালু করাতে পাকিস্তান সচেষ্ট হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মেনে চলে। কিন্তু শরণার্থীদের ট্র্যাজিক অবস্থা এবং পাকিস্তান যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে কারও পক্ষে নির্বিকার থাকা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে সমস্ত মানবাজাতিরই ভাবা উচিত। এখন জাতিসংঘের অধিবেশন চলছে, বিষয়গুলো উত্থাপনের এটাই সঠিক ফোরাম বলে মনে হচ্ছে।
(৩ অক্টোবর ১৯৭১ প্রকাশিত)
দ্য বাল্টিমোর সান
ভয়ই পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র আইন
পাটকলের এক যুবক সুপারিনটেনডেন্ট বলল মাত্র ক’ঘন্টা আগে তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। সেনাবাহিনী গ্রামে ঢোকার পর গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছে, এক তরুণ গ্র্যাজুয়েটকে হত্যা করেছে। সেনাবাহিনী কেন এসেছে তাঁর জানা নেই। রাস্তা ধরে আরও এগোবার পর দেখা গেল ছটা গ্রাম পুড়িয়েছে। গেরিলা তৎপরতার প্রতিশোধ হিসেবে ক’জন গ্রামাবাসীকেও হত্যা করেছে।
যখন জিজ্ঞেস করা হল কাজটা ভুলে মুক্তিবাহিনীই করেছে কিনা একথা শোনার পর যেন ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত বোধ করেছে—এভাবে এগিয়ে এলো সুপারিনটেন্ডেন্ট এবং একজন স্কুল শিক্ষক।
‘না স্যার, না। পাকবাহিনী, ওরা পাকবাহিনী, পাক বাহিনী।’
পাটকলের সুপারিনটেনডেন্ট বলল, আমাকে পালাতে হয়েছে কারণ সেনাবাহিনী সব শিক্ষিত লোকদের মেরে ফেলছে। যাতে কেউ আর নেতৃত্ব দিতে না পারে। স্কুল শিক্ষক তাঁর কথায় সায় দেয়।
একমত ঢাকার কুটনীতিবিদরাও—যারা সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সাক্ষ্য সংগ্রহ করছেন। তারাও মনে করেন দেশের অধ্যাপক, ডাক্তার, আইনজীবী, ছাত্র ও অন্যান্য শিক্ষিত মানুষকে পদ্ধতিগত হত্যা করা হচ্ছে কিংবা কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
(১৩ নভেম্বর ১৯৭১ প্রকাশিত
http://arts.bdnews24.com/?p=3273#more-3273
বাংলাদেশ
উত্তরমুছুন